সাতসকালে পচাদার চায়ের দোকানের সামনে ঝানুজ্যেঠুর মুখে এরকম একটা দার্শনিক প্রশ্ন শুনে ভ্যাবলা চমকে উঠলেও, পচা কিন্তু সাথে সাথে উত্তর দিল, "এখনও হইনি তো!"
"For once, you are correct পচা," ঝানুজ্যেঠু কিন্তু বেশ গম্ভীরভাবেই পচার কথায় সায় দিল, "এক্কেবারে ঠিক কথাটা বললি তুই!"
ভ্যাবলা পচাদার কথায় হো হো করে হেসে উঠতে গিয়েও জ্যেঠুর এরকম গম্ভীর মন্তব্যে যারপরনাই অবাক হয়ে গেল।
"কি বলছ কি গো পচাদা? আমরা সভ্য নই?"
পচার অবশ্য যুক্তি ছিল কথাটা বলার। ওর মনে পড়েছিল যে ডার্বির দিন যখন দুই প্রধান এক হয়ে তিলোত্তমার বিচারের জন্য গলা ফাটাচ্ছিল, ভ্যাবলাদাও উত্তেজনার চোটে ঝানুজ্যেঠুকে কোলে তুলতে গিয়েছিল। তখন জ্যেঠু ধমক দিয়ে বলেছিল, "এই বাঁদর, কি অসভ্যতা করছিস! নামা শিগগির!" তাই পচার মনে হয়েছিল যে ভ্যাবলাদা যদি কলেজে পড়ে অসভ্য হতে পারে, তো মানবসভ্যতারও অসভ্য হওয়া আটকাচ্ছে কে?
কিন্তু কি আশ্চর্য! এখন তার এই যুক্তিটাই বোঝাতে যেতে জ্যেঠু এবার তাকেই কিরকম বেদম বকে দিলো!
"উফফ পচা! ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল বটে যে তোর মাথাটায় বুদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু না, ওটার দশা যেই কে সেই!"
-"খামোখা বকছ কেন? তুমিই তো বললে যে আমি ঠিক, আমরা এখনো সভ্য হইনি! তার মানে কি ভ্যাবলাদা ছাড়া বাকিরা সভ্য?" পচা এবার নিজের ভুলটা বোঝার চেষ্টা করে।
-"আবার কি", তড়িঘড়ি কথাটা বলে পরক্ষণেই আবার জিভ কেটে ভ্যাবলা বলে, "মানে, আমিও সভ্য গো, ও তো জ্যেঠু আদর করে বলেছে! এই দেখো না, আমি সভ্য, তোমরা সভ্য। গোটা দুনিয়া সভ্য। সভ্যতা কি আর আজকের কথা গো পচাদা, সেই চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু....", আবেগে ভ্যাবলার গলা বুজেই যেত হয়তো যদি না জ্যেঠু মাঝপথে একটা পিলে চমকানো গর্জন দিতো
-"হ্যাং ইয়োর মেসোপটেমিয়া, আমরা নিতান্তই অসভ্য!" জ্যেঠুর হুঙ্কারটা পুরো জজসাহেবের হাতুড়িমার্কা হুকুমের মতো শোনালো। বকরবকর না করে সোজা সিলমোহর লাগিয়ে দিলো যেন নিজের সিদ্ধান্তে।
"কি বলছো কি গো জ্যেঠু? আমরা অসভ্য? এটা একটা কথা হলো?" ভ্যাবলা কিছুতেই মানতে পারে না জ্যেঠুর মন্তব্য।
"অফকোর্স অসভ্য", জ্যেঠু এবার বলতে শুরু করে, "অসভ্য না হলে কি তিলোত্তমার উপর হওয়া অমানবিকতার বিচার পেতে মাসখানেকেরও বেশি সময় দরকার পড়ে?"
"আচ্ছা আচ্ছা, তুমি আর জি করের প্রসঙ্গে বলছ?" ভ্যাবলা এবার আস্তে আস্তে জ্যেঠুর রাগের কারনটা ধরতে পারে, "কিন্তু তার আর কি করা যাবে বলো! ইন্ভেস্টিগেশনটা আগে ঠিক করে করতে হবে তো!"
"ইন্ভেস্টিগেশন? কি করে করবে শুনি ইন্ভেস্টিগেশন? সব তথ্য প্রমাণ তো লোপাট করে দিয়েছে গুণ্ডার দল!" ঝানুজ্যেঠু আজ পুরো ক্ষেপে ব্যোম!
"তাই?" পচা জানতে চায়, "সমস্তটাই নষ্ট? কিছুই কি পাওয়া যাবে না?"
"কি করে যাবে শুনি? একটা মৃতদেহ পাওয়া গেল! হুড়োহুড়ি করে তার ময়না তদন্ত হলো, ঘরটাকে সিল করলো না ঠিক করে, পরদিন দিল ঘরটাকেই ভেঙে! কি, না রেনোভেশন হবে! আর পুরোটাই হলো প্রশাসনের নাকের ডগার উপর দিয়ে! কি শয়তানি! কি শয়তানি!" ঝানুজ্যেঠু আজ তেড়িয়া হয়ে বলে চলে, "তদন্তকারীরা তো আর ভগবান নয় যে হাওয়া থেকে সূত্র বার করবে!"
"ঠিক বলেছো গো," পচা সায় দেয়, "মেয়েটার দেহটাও যদি থাকত! তাও দিল হুড়মুড় করে পুড়িয়ে! বজ্জাতগুলো বেচারির বাপমাকে ঠিক করে শোকটাও করতে দিলো না!"
"শোক করতে দেবে?" ঝানুজ্যেঠু সমাজকে আর এক রাউণ্ড ধমকে দিল, "তাহলেই হয়েছে! যে সমাজে অস্বাভাবিক মৃত্যুকে প্রথমেই আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, যে সমাজে অস্বাভাবিক মৃত্যুর এফআইআর দায়ের করতে প্রায় বারো ঘণ্টা লেগে যায়, সেখানে মেয়েটির দেহ যে গুম হয়নি, তাই আমার চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য রে!"
"আরে গুম করা কি মুখের কথা?" ভ্যাবলা বলে, "একটা সরকারি হাসপাতালে তো লোক গিজগিজ করে সারাক্ষণ, গুমটা করবে কি করে?"
"কথাটা অবশ্য খুব একটা ভুল বলিস নি তুই," জ্যেঠু সায় দিয়েও একটু বাঁকা হাসি হাসে, "কিন্তু বল দেখি, একটা লোক গিজগিজ করা জায়গায় একটা বীভৎস খুন হয়ে গেল, আর কেউ জানতেও পারলো না?"
"তাই তো! এটা তো আগে ভেবে দেখিনি!" ভ্যাবলা মাথাটা একটু চুলকে নেয়, "সত্যি তো, কিছু তো একটা গণ্ডগোল আছে! এরকম পাশবিক কাণ্ড...."
"পাশবিক?" জ্যেঠু কথাটা শেষ করতে দেয় না, "কি বলছিস রে ভ্যাবলা? পশুরাও এত নির্দয় হয় না! এটা তো এক পৈশাচিক কাণ্ড! তিলোত্তমা কি দোষ করেছিল বল? সে তো চেয়েছিল সমাজের সেবামূলক কাজে নিজেকে ব্রতী করতে! কিন্তু দেখ, তার বদলে সে কি পেল? কিছু অমানুষের হাতে নিজের প্রাণটাকে নারকীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে খোয়ালো! উফফ, তার শেষটা কি ভীষন কেটেছিল ভাব! আর তারপর তো শুরু হলো তার মৃত্যুর কারনটাকে ধামাচাপা দেওয়ার এক অসভ্য প্রচেষ্টা!"
"ঠিক বলেছো গো," পচা বলে, "একটা ডাক্তার হয়ে সুরক্ষা পেলো না গো মেয়েটা, আর আমরা সাধারণরা কি পাব?"
"কেন পুলিশ আছে তো!" ভ্যাবলা বলে, "পুলিশ দেবে সুরক্ষা!"
"তাই নাকি? কি জানি বাবা!" পচা বলে, "তাহলে তো তোমাদের প্রথম রাত দখলের শুরুর সাথে সাথেই যে শুনলাম কিছু গুণ্ডার দল আর জি করে তাণ্ডব চালালো, তখন কি তোমার পুলিশ ঠিকঠাক সুরক্ষা দিতে পেরেছিল? তারা তো দিব্যি ভাঙচুর করে এলো!"
"কি করে করবে বল?" পাশ থেকে জ্যেঠুও গলায় স্পষ্ট বিদ্রুপের সুর ফুটিয়ে বলে, "হয় পারমিশন ছিন না, নয়তো যথেষ্ট লোকবল ছিলো না!"
"লোকবলটাই কারন বোধহয়....." ভ্যাবলা বলে, 'দেখলে না ডার্বিটাই এবার বন্ধ করে দিলো যথেষ্ট সিকিউরিটি ছিল না বলে!"
"দেখলাম তো!" জ্যেঠুর গলায় আবার তীব্র শ্লেষ, "তারপর তো দুই প্রধানের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আটকাতে পুলিশের ঢল দেখে অবাকও হলাম! ভাব দেখি ভ্যাবলা, এতো পুলিশ রাতারাতি এলো কি করে? আর যদি এলোই বা, তবে ডার্বিটা হতে কি দোষ করেছিল? ডার্বির সিকিউরিটি দিতে কি এর থেকেও বেশি পুলিশ লাগত?"
"তা অবশ্য ঠিক! এত পুলিশ বোধহয় লাগত না ডার্বি করাতে!" মাথাটা আরো একবার চুলকে ভ্যাবলা ব্যাপারটা ধরতে পেরে স্বীকার করে। তারপর অবশ্য বলে, "কিন্তু সি বি আই তো আছে, আর সুপ্রিম কোর্ট?"
"ঠিক, সি বি আই এখন একমাত্র ভরসা!" জ্যেঠু সায় দেয়, "কোর্টের উপরও আশা রাখতে হবে আমাদের! নয়তো সাধারন মানুষ যাবে কোথায়?"
"কিন্তু ওদের তো শুনছি কি এক বিটকেল উকিল আছে!" পচা সাথে সাথে আশঙ্কা জানায়, "কপিল না বল না কি একটা নাম, কি কায়দা করে তিলোত্তমার বিচারটার পাশ কাটিয়ে জুনিয়র ডাক্তারের আন্দোলনের দিকে পুরো আলোচনার মোড়টা ঘুরিয়ে দিলো!"
"আরে ছোঃ!" ঝানুজ্যেঠু ধিক্কার দেয়, "কপিল সিব্বলের কথা বলছিস তো? কপিল ছিল বটে একটা আমাদের সময়কার, কপিল দেব নিখঞ্জ! বোলার! দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিল বিশ্বকাপটা এনে দিয়ে! এই যে কপিলের কথা বললি, নামে বল থাকলেও লোকটা একের নম্বরের ধড়িবাজ! কার যে মুখ উজ্জ্বল করতে চাইছে কে জানে? তবে চিন্তা করিস না খুব একটা! আমাদের দিকেও যিনি আছেন, তাঁর নামের মধ্যে জয় ও সিংহ দুইই আছে, দেখি মা সিংহবাহিনীর কি ইচ্ছা, হয়তো এই সিংহের হাতেই জয় আসবে! আসলে কি জানিস, যত দিন যাবে, তত বজ্জাতগুলোর মধ্যে ভয় কমবে! আমাদের দেশে তো চরম শাস্তি বলতে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন....."
"আমার তো ইচ্ছে করে দিই কেটলির গরম জলে চুবিয়ে ব্যাটাগুলোকে!" পচা মুখটুখ পাকিয়ে স্বগতোক্তি করে!
জ্যেঠু অবশ্য খেয়াল না করে বলেই চলে গম্ভীরভাবে, "..... তাই দৃষ্টান্তমূলক কিছু করতে চাইলে, তার একমাত্র উপায় তাড়াতাড়ি সঠিক বিচার! দেরি করলে তো দোষীরাও তাদের চাল দেওয়ার ময়কা পাবে আর বাইরে যে দুষ্কৃতীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মনে দোষ করলে শাস্তি পাওয়ার ভয়টা কমবে! সমাজবিরোধীরা আরো মাথাচাড়া দেবে আর আমরা সাধারন মানুষের দল থরহরি কম্পমান হয়ে থাকব! তাই তো তোদের জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি সত্যিই সভ্য হতে পারলাম?"
জ্যেঠুর কথায় কি ছিল কে জানে, পচা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল, "পারবো গো পারবো, দেবীপক্ষ আসছে, দেবীর কাছে চলো তিলোত্তমার জন্য ন্যায়বিচারের প্রার্থনা করি! আমরা ন্যায়বিচার দাবী করি সমাজের কাছে! দেবী আমাদের কথা ঠিক শুনবেন দেখো! বিচার আমরা ঠিক পাবোই পাবো। দুগ্গা দুগ্গা!"
3 comments:
বাহ্ বাহ্ বাহ্ চমৎকার বিশ্লেষণ এবং সময়োপযোগী।
Bhalo lekha
খুব ভাল লাগল। চিন্তাধারার খুবই ভাল
Post a Comment