Sunday, September 05, 2021

সিরিয়াল কিলার

ভ্যাবলার খুব শখ হয়েছে যে বড় হয়ে টিভিতে সিরিয়াল পরিচালনা করবে। বিষয়টা নিয়ে অবশ্য খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করেনি। তবে তার সদ্য মাধ্যমিক দিয়ে পাশ করা বুদ্ধি অনুযায়ী কাজটা সমস্যার বলে মনে হয়নি। তো তাই নিয়েই সেদিন ঝানুজ্যেঠুর সাথে আলোচনা করছিল। পাড়ার চায়ের ঠেকে ছুটির দিনে সকাল থেকেই লোক জমতে শুরু করেছে। ভ্যাবলাও ছিল, জ্যেঠুও প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফেরার পথে দোকানে ঢুকেছিলেন জিরোতে। পাড়াতে জ্যেঠুর একটা ফোটো তোলার দোকান আছে। অবশ্য উনি ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন কারন ডিজিটাল যুগে খদ্দেররা বড্ড অধৈর্য, তাদের সামলাতে গেলে ডিজিটাল যুগের ছেলেরাই ঠিক। তবে সে ব্যাবসা যেই চালাক না কেন, ফটোগ্রাফি নিয়ে মতামত জানতে লোকজন এখনও ওনাকেই স্মরণ করে। তাই তাঁকে দোকানে পেয়ে ভ্যাবলা আর কালবিলম্ব না করে পাকড়াও করল।
ভ্যাবলা শুরু করল, "বুঝলে জ্যেঠু, ভাবছি পড়াশোনাটা শেষ করেই সিরিয়াল বানাতে শুরু করব।"
"চাষ করবি?" জ্যেঠু ভেবেছেন ভ্যাবলা cereal বলেছে!
"আহ জ্যেঠু! কি যে বলো! চাষের কথা আসছে কোথা থেকে?"
ঝানুজ্যেঠু অবাক, "কিন্তু তুই যে বললি cereal বানাতে শুরু করবি।"
"উফ জ্যেঠু! তোমাকে নিয়ে আর পারিনা সত্যি! বলছি সিরিয়াল করব গো, টিভি সিরিয়াল", ভ্যাবলা বিরক্ত মুখে বলে।
"কি? সিরিয়াল করবি? তো বানাতে শুরু করব বলছিস কেন? এ কি আমাদের পচার চা নাকি যে জল গরম করলাম আর বানিয়ে ফেললাম?" এবার জ্যেঠুকে বেশ বিরক্ত লাগে।
এবার দোকানের মালিক নিজের নাম আর সিরিয়াল একসাথে শুনে চায়ের ডেকচি হাতে বেরিয়ে এসে বলে, "কি বললে জ্যেঠু, সিরিয়াল বানাবে? আমাকেও নেবে? কি চরিত্র দেবে? নায়কের?"
"আমি বানালে তোকে চায়ের পাতার চরিত্রটা দিতাম", জ্যেঠু গম্ভীর মুখে মন্তব্য করেন, "তবে আপাতত কেউ বানাচ্ছে না, ভ্যাবলা সিরিয়াল বানানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছে।"
"ঠিক", গর্বিত মুখে সায় জানায় ভ্যাবলা, "সিরিয়াল বানানোটা পুরোপুরি আমার ইচ্ছে পচাদা, তাই জ্যেঠুর থেকে একটু বুদ্ধি নিচ্ছিলাম।"
চোখটা গোলগোল করে ভ্যাবলাকে জরিপ করতে করতে পচা অবাক হয়ে জানতে চায়, "তুমি করবে? তুমি তো সবে মাধ্যমিক দিলে!"
"তো কি হল? আমি কি বলেছি এক্ষুনি সিরিয়াল বানাবো!" ভ্যাবলা তেড়ে যায়, "আপাতত ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি, সামনের দুটো বছর যেতে দাও, তারপরই নামাব!"
"আবার সেই নামাব!" জ্যেঠু এবার হতাশ হয়ে ভ্যাবলাকে জিজ্ঞেস করেন, "বলি এ কি তোর বাড়ির চাল ফোটানো পেলি যে তখন থেকে নামাবো, বানাবো করছিস! সিরিয়াল বানানো কি এতই সোজা?"
"আবার কি?" জল গড়ানো অব্দি রান্নার বিদ্যা নিয়ে ভ্যাবলা বলে, "তবে চাল ফোটানোর মতো অমন সোজা কাজ না হলেও খুব কঠিন কিন্তু নয় ব্যাপারটা।"
"কঠিন নয়? তাহলে বরং তুই সিরিয়াল বানানোর কথা না ভেবে চলচ্চিত্র করার কথা ভাব", জ্যেঠুর ব্যাঙ্গোক্তি।
ভ্যাবলা অবশ্য সেটা ধরতে না পেরে গম্ভীর হয়ে বলে, "সে আমি ভেবে দেখেছি আগেই, সিরিয়াল বানালে লোকে চিনবে বেশি।"
"কি করে?" ভ্যাবলাকে ব্যাঙ্গোক্তিটা এরকম গুরুত্ব সহকারে নিতে দেখে ঝানুজ্যেঠু অবাক।
"সহজ হিসেব," ভ্যাবলার চটজলদি উত্তর, "কোনো চলচ্চিত্র রিলিজ হওয়ার পর কতদিন হলে চলে?"
"কতদিন?" পচার জিজ্ঞাসা।
"খুব নাম করলেও, চলে মাসখানেকের বেশি নয়, তারপর কম লোকই যায় দেখতে।"
"সে ঠিক, সেবার গুরুর ছবি এলো, হেব্বি ঝাড়পিটের, দ্বিতীয় সপ্তাহে রাতে গেলাম দেখতে, শুনলাম ম্যাটিনি করে দিয়েছে, তো পরের হপ্তায় ঠিক সময় গেলাম, শুনলাম চলে গেছে," পচা অভিমানে চায়ের জলের মতো ফুটতে থাকে, "কেবলদাদাকে বলেছি, ছবিটা যদি শোনে টিভিতে দেবে যেন জানায়, দোকান বন্ধ করে রাখব দুপুর থেকে।"
"তবেই দেখ, ছায়াছবি ব্যাপারটা এরকমই, তুমি দেখতে চাইছো, কিন্তু সময় ম্যাচ করছে না," উৎসাহ পেয়ে ভ্যাবলা বলতে থাকে, "এদিকে সিরিয়ালের বেলায় দেখো, তিনশো পয়ঁষট্টি দিন একই সময়ে দেখিয়ে যাচ্ছে, সে তুমি দেখত চাও কি না চাও! সেই সুযোগে পরিচালকের নামটাও লোকে জানছে ওই তিনশো পয়ঁষট্টি দিন ধরে। ছায়াছবি হলে কি হত?"
"ঠিক, তুই বানালে তো কিছুতেই হত না!" জ্যেঠুর স্বগোতক্তি।
পচাও নিজের মত জানিয়ে দেয়, "না, হত না, তুমি সিরিয়ালই বানাও ভেবলুদা! দেখার জন্য আমরা তোমার পাশে আছি।"
"বাপরে বাপ! তোর সিরিয়াল বানানোর কথাতেই দর্শক রেডি, কি ডিমান্ড রে!" জ্যেঠুর গলাটা ফের কৌতুকের মতো শোনাল।
"তাহলে আর বলছি কি? সিরিয়াল এখন পুরো happening জিনিস জ্যেঠু," ভ্যাবলা বলে।
"তা তুই যে সেই তখন থেকে বানাবি, নামাবি করছিস, সিরিয়াল করার জানিসটা কি তুই?" জ্যেঠুর জিজ্ঞাসা।
"জানার তো বেশি কিছু বুঝতে পারলাম না এত সিরিয়াল দেখে। অভিনেতারা অভিনয় করে যাবে, আমরা তার অভিনয় রেকর্ড করব, হয়ে গেল।" বিজ্ঞের মতো জানায় ভ্যাবলা।
জ্যেঠু তো শুনে চমকে ওঠেন, "অভিনেতারা অভিনয় করবে আর তুই রেকর্ড করবি, হয়ে গেল? তুই তো চলচ্চিত্রে বিপ্লব আনতে চলেছিস রে। দৃশ্যের এডিটিং নেই, background music নেই, চরিত্র আর site বাছাই করা নেই, সবার উপরে গল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা নেই, ভাষাটা বাঙলা করবি তো?" শেষ কথাটা ব্যাঙ্গের ছলে বলে ওঠেন জ্যেঠু।
"কি ভেবেছ কি তুমি জ্যেঠু, এসব নিয়ে কি কিছুই ভাবিনি?" এবার ভ্যাবলার পালা ঠাট্টা করার।
"ভেবেছিস?" জ্যেঠু এবার, সত্যি বলতে কি, আগের থেকেও বেশি চমকান।
"ভাবিনি আবার?" ভ্যাবলা বলে চলে, "বাঙলা সিরিয়াল করব, অভিনেতাদের যাচাই করে তবেই সুযোগ দেব, বাছাই পর্বে যারা প্রবল স্মৃতিশক্তি প্রদর্শন করে দেখাতে পারবে তারা অগ্রাধিকার পাবে, indoor site যদি বলো তো বড় একটা হলঘর হলেই চলবে, কয়েকটা আসবাব শুধু জায়গা হিসেব করে বসিয়ে দিলেই হবে, তবে গল্পের ব্যাপারটা ভাবিনি খুব বেশি কারণ এখন তো concept নিয়ে কারবার। concept হচ্ছে আমাদের কানের মতো, ওটা টানলেই গল্প আমাদের মাথা থেকে বেরিয়ে আসবে।"
"সাংঘাতিক তো," পচা নিজের কানটা ধরে একটু টেনে নেয়, "কান টানলে মাথা আসে শুনেছিলাম, গল্পও বেরোয়? তা, তোমার মাথা থেকে কি বেরোলো ভেবলুদা?"
"বুদ্ধিটা!" জ্যেঠুর মন্তব্য, "যতটুকু ছিল, পুরোটাই।"
"আওয়াজ দিচ্ছো তো?" ভ্যাবলা এবার জ্যেঠুর ব্যঙ্গটা ধরতে পারে, তাহলে তোমাকে বলি শোনো, আজকালকার সিরিয়ালে যা concept use করছে সেটা বেতাল পঞ্চবিংশতি পড়া থাকলেই হয়ে যাবে। আমিও সেরকমই কিছু করব ঠিক করেছি।"
পচা তো কৌতুহলি হয়েই উঠেছিল, এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ল, " কি বললে ভেবলুদা, তুমি অরণ্যদেব আর পঞ্চতন্ত্রের গল্প পাঞ্চ করবে সিরিয়ালে?"
"পচারে", জ্যেঠু ভেবলার concept সম্বন্ধে বক্তব্যে খানিকটা চমকে ওঠার আগে পচার মন্ত্যব্যে ক্ষেপে উঠলেন, "আমি তোর নাকের উপরেই এবার পাঞ্চ ঝাড়ব যদি আবার বাজে কথা বলিস। ভ্যাবলা ওটা বিক্রম বেতালের গল্প বলছে, অরণ্যদেব আর পঞ্চতন্ত্র নয়।"
"অ", পচা বেজার মুখে বলে, "তা ওরকম বেতাল পঞ্চব্যঞ্জন বলছো কেন? ও তো বিক্রম বেতাল বললেই হয়!"
বইটার ওরকম গোত্র পরিবর্তন হতে দেখে পচাকে ফের বকুনি দিতে গিয়েও কি ভেবে থেমে জ্যেঠু ভ্যাবলার দিকে ফিরে বললেন, "কিন্তু এবার আমারও খানিকটা কৌতুহল হচ্ছে, আজকালকার সিরিয়াল এতটা গভীরে ঢুকে research করছে? তবে তো দেখতে হয় এবার মাঝেমধ্যে!"
"তবে আর বলছি কি," উৎসাহ পায় ভ্যাবলা।
"কিন্তু কি concept চলছে খুলে বল তাহলে," ঝানুজ্যেঠু এবার সত্যিসত্যি কৌতুহলী।
"ব্যাপারটা হচ্ছে কি", ভ্যাবলা এবার মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে গুছিয়ে শুরু করল, "সেই যে একটা গল্প ছিল না, এক রাজ্যের রাণী আর রাজকুমারী বনে ঢুকে হারিয়ে গেল আর অন্য এক রাজ্যের রাজা আর রাজকুমার তাদের দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে উপস্থিত হলো।"
"মানে রাণীর রাজ্যে না রাজার রাজ্যে?" পচার প্রশ্ন।
"রাজার রাজ্যে!" ভ্যাবলার উত্তর।
"তাহলে রাণীর রাজা, মানে রাণীর স্বামীর কি হল?" পচা পুরো সিবিআই অফিসারের মতো প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
"থানায় নিরুদ্দেশের নোটিস দিতে গেল!" জ্যেঠু এবার গর্জে উঠলেন, "থামবি তুই? গল্পটা পুরো বলতে না দিয়ে শুধু প্রশ্নই করে চলেছে, যেন হাইকোর্টের উকিল।"
জ্যেঠুর গর্জনে পচা একটু মিইয়ে গেলেও মিনমিন করে বলল, "আমি তো ব্যাপারটা just কিলিয়ার করে নিচ্ছিলাম। বকছ কেন শুধুমুধু?"
"আর কিলিয়ার করে কাজ নেই!" ভেংচে ওঠেন জ্যেঠু, "চুপ করে শুনে যা, শেষ হওয়ার আগে আর কথা নয়।"
তারপর ভ্যাবলার দিকে ফিরে বলেন, "নে ভ্যাবলা, বাকিটা বল।"
"বলছি তো," ভ্যাবলা summarise করে আবার শুরু করে, "তো ব্যাপারটা হচ্ছে এক দেশের রাণী আর রাজকুমারী অন্য দেশের রাজ্যে থাকতে শুরু করল। এবার, in due course of time, রাজার রাজকুমারীকে পছন্দ হওয়াতে তাকে বিয়ে করে ফেলল আর রাণিমাও রাজকুমারকে বিয়ে করল।"
"হতেই পারে না, তোমার নিশ্চয়ই কোথাও গণ্ডগোল হয়েছে ভেবলুদা!" পচা আর থাকতে পারে না। জ্যেঠুর নির্দেশ ভেঙে শুধরে দিতে চায়, "ওটা নিশ্চয়ই রাজা-রাণী আর রাজকুমার-রাজকুমারীর বিয়ে বলতে চাইছো তুমি। বলো, ঠিক ধরেছি তো?"
"পচাদা, তুমি থামবে!" এবার ভ্যাবলাই বিরক্ত হয়, "যা বলেছি, ঠিক বলেছি! এটা থেকেই বেতালের প্রশ্নটা আসছে আর আসছে আমার concept!"
"তোকে না মানবাধিকারে ধরে!" জ্যেঠুর মৃদু মন্তব্য, তারপর অবশ্য জানতে চান, "তা প্রশ্নটা কি ছিল?"
প্রায় এ কান থেকে ও কান অব্দি চওড়া একটা হাসি হেসে ভ্যাবলা বলে, "বেতালের প্রশ্নটা ছিল অনেকটা এইরকম, রাজকুমারীর যে বাচ্ছাকাচ্ছা হবে তারা কি তাদের সৎদাদাকে দাদু বলবে?"
"কি বললে? দাদাকে দাদু বলবে! কেন?" পচার এবার পুরো গুলিয়ে যায়।
"কারন রাজকুমারীর বাচ্ছার বাবার দিক থেকে দেখলে সৎদাদা হচ্ছে রাজকুমার আর মায়ের দিক থেকে ধরলে সেই রাজকুমার-ই হচ্ছে তার দিদার স্বামী, অতএব দাদু। বুঝলে?" ভ্যাবলা মুচকি হাসে।
"কি ভয়ানক, তা বিক্রম উত্তর দিতে পারলেন?" পচা আবার চিন্তায় পড়ে গেল।
"বিক্রম কি করতে পারলেন সেটা প্রধান না, ঘটনা হচ্ছে, ভ্যাবলা যদি আজকে এরকম অবাস্তব আর অশালীন প্লট নিয়ে সিরিয়াল করে তবে কেলেঙ্কারি ঘটবে চারিদিকে।" জ্যেঠুর উপলব্ধি।
"আহ, জ্যেঠু!" অভয় দেওয়ার মতো করে ভ্যাবলা বলে, "আমি কি তাই বলেছি তোমাদের? আমি তো concept-টার কথা বলছি। এমন এক concept, যা ধরতে ধরতেই সময় কেটে যাবে, দর্শক বুঝতেই পারবে না। এটাই এখন hype গো!"
"ইয়ার্কি পেয়েছিস? এরকম অশোভন ব্যাপার দেখানো hype?" জ্যেঠু রেগে গেছেন।
"উফফ জ্যেঠু, আবার ভুল বুঝলে! আরে এরকম বলতে কি একরকম বলছি নাকি? সম্পর্কের খিচুড়িটা থাকবে তবে এরকম across the generation হবে না!" ভ্যাবলা বুঝিয়ে দেয়।
"তবে কি হবে শুনি?" জ্যেঠুর অস্থিরতা কাটছে না কিছুতেই।
"এখন যেটা চলছে সেটা অনেকটা এরকম," ভ্যাবলা খোলসা করে, "ধরো, হিরোর সাথে হিরোইনের বিয়ে হল....."
"এ তো তুমি last scene-এর কথা বলছ", পচা ফোড়ন কাটে।
"পচাদা," বিরক্ত মুখে ভ্যাবলা বলে, "তুমি না পুরো সেকেলে হয়ে গেছ। হিরো হিরোইনের বিয়ে আগেকার যুগে শেষে হত, এখন ওটা দিয়েই শুরু হয়। তুমি এখন শুধু চুপচাপ শোনো।"
পচা আবার মুষড়ে পড়ে, "আচ্ছা আচ্ছা, আর কিছু বলব না, বলে যাও।"
"Yes, চুপ করে শোনো। যা বলছিলাম," ভ্যাবলা continue করে, "হিরোর সাথে হিরোইনের বিয়ে হওয়ার কয়েকদিন পর আরেক হিরোইনের আবির্ভাব হয় যে নাকি হিরোর পুরনো স্ত্রী but তার কথা কেউ জানতো না। হিরোও না জানতে পারে কারণ মাঝে তার স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গেছিল।"
"সেরেছে," পচার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে।
"আরে wait," ভ্যাবলা বলে, "সারার আর কি দেখলে। এই তো গেল দ্বিতীয় হিরোইনের কথা। এবার তারপর দেখা যায় যে সেই দ্বিতীয় হিরোইন এখন ফের বিবাহ করেছেন।"
"পচা, তোর হিসেবের খাতা যদি হাতের কাছে থাকে নিয়ে আসবি বাপ!" জ্যেঠুর আর্তিটা genuine শোনাল।
"আরো আছে, এদিকে দেখা যায় প্রথম হিরোইনের ছোটবেলায়, তাদের গ্রামের এক নিষ্ঠুর জমিদারের সাথে বালিকা বিবাহ গোছের ব্যাপার হয়েছিল যেটার পরে তারা পালিয়ে শহরে চলে আসে!" ভ্যাবলা বলে চলে, "এদিকে সেই জমিদারের আরেক পক্ষের স্ত্রী আবার দ্বিতীয় হিরোইনের প্রথম স্বামীর প্রথম পক্ষ।"
"বাপরে!" পচার শকে চলে যাওয়ার জোগাড় হয়, "এরকম চলতে থাকলে তো হিরো নিজেই না নিজেকে প্রশ্ন করে বসে, 'আমি কি আমার স্বামী?'"
"Exactly!" ভ্যাবলা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে, "দর্শকদের থেকে এরকমই কিছু reaction দরকার। মানে জটিলতাটা এমনই হবে যে জট ফেলতে ছ-মাস আর খুলতে ছ-মাস। মানে পুরো একটা বছরের গল্প তৈরি।"
"খুলবে মনে করছিস?" জ্যেঠুর সরস প্রশ্ন, "যা জট বানালি, তা খুলতে খুলতে না তোর চুলদাড়ি পেকে যায়।"
"খুলবে, ঠিক খুলবে! না খুললে কয়েকটা চরিত্রকে মাঝপথে পটল তুলিয়া দেব, জট আপনিই খুলে যাবে," ভ্যাবলার উত্তর।
এরকম সমাধানের চোটে পচার ক্রমাগত বাড়তে থাকা হাঁ মুখটার দিকে তাকিয়ে জ্যেঠু বলেন, "তুই বরং তোর প্রতিটা episode শুরু করার আগে warning message দিয়ে রাখিস, 'দয়া করিয়া মুখে mask পরিয়া সিরিয়াল দেখিবেন', কারণ তোর সিরিয়াল যে concept অনুযায়ী চলবে, তাতে দর্শকরা ঘনঘন হাঁ করবে আর তখন corona তো ছোটোখাটো ব্যাপার, মুখের মধ্যে চড়ুই পাখি ঢুকে গেলেও আশ্চর্য হব না!"
"আবার মজা করছো তো?" ভ্যাবলা এবার রেগে গিয়ে বলল।
"মজার আর কি করলাম বল," পচার মুখের দিকে ইঙ্গিত করে জ্যেঠু বলেন, "তোর ভবিষ্যৎ দর্শকের অবস্থা দেখে বলছি।"
ভ্যাবলা তাকাতেই পচা মুখটা বন্ধ করে একটা ঢোক গেলে। অবশ্য জ্যেঠু এবার ভ্যাবলার ধারনা সম্বন্ধে যে বেশ উৎসাহী তা বোঝা গেল ওনার পরের প্রশ্নে, "তা ভ্যাবোল, তোর ওই হলঘর আর প্রখর স্মৃতিশক্তিধরদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণগুলোই কি এরকম কিছু কারণে?"
জ্যেঠুর মুখে তার আদরের নাম ভ্যাবোল শুনে দ্বিগুন উৎসাহে ভ্যাবলা বলে, "ওগুলো খরচ কমানোর জন্য দরকার যা বুঝেছি।"
"কিরকম শুনি?" জ্যেঠুর কৌতুহল প্রকাশ পেল আবার।
"ব্যাপারটা হচ্ছে, আজকাল সিরিয়ালে একটা প্রকাণ্ড হলঘর থাকে।" ভ্যাবলা বলে, "সেখানেই যত গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হয়। সেটাতে আসবাব থাকে তবে সেগুলো সিনিয়র অ্যাক্টরদের বসার জন্য। বাকিরা সবাই দেখি দাঁড়িয়ে থাকে। বসার জায়গা থাকলেও বসে না, ওটাই নিয়ম। আর ওই হলঘরটা পুরো strategic location হয় বাড়িটার। মানে তুমি বাইরে বেরোচ্ছ, হলঘর পার করতে হবে, একটা ঘর থেকে আরেকটা ঘরে যাচ্ছে, হলঘর পেরোতে হবে, একতলা থেকে দোতলা যাচ্ছ, হলঘর পেরিয়ে যেতে হবে।"
পচা ফোড়ন কাটে, "বাথরুম পেলে? তখনও হলঘর পেরিয়ে?"
"বোধহয়," ভ্যাবলার চটজলদি জবাব, "তবে অতটা details কখনও সিরিয়ালে দেখায় না। যাই হোক, একটা হলঘর এরকম বাড়ির মাঝে থাকার দরুন যে কোনো আলোচনা একবার যদি হলঘরে শুরু হয়, তখন আশপাশের যত ঘর আছে, সমস্ত জায়গা থেকে বাকি চরিত্ররা চট করে আলোচনায় সামিল হতে পারে। শাশুড়ি বউমার মধ্যে কথা চলছে হয়তো যে প্রেশার কুকারে কটা সিটি পড়েছে, ছটা না আটটা, শ্বশুর বেডরুম থেকে দৌড়ে এসে বলছেন চারটে, ছেলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলছে দুটো বড়, একটা ছোটো সিটি শুনতে পেয়েছে, বাড়ির নাতি দোতলা থেকে নেমে বলছে দশটা শুনেছে, গেস্টরুমে যে অতিথি বছরের পর বছর পড়ে আছে তার বক্তব্য যে সে শোনেইনি সিটি পড়েছে, দেওর বাইরে বেরোচ্ছিল, বলে গেল সে সাতখানা অব্দি গুনতিতে পাচ্ছে। মানে আলোচনা শুরু হলো তো সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গোটা পরিবারের সবার। একমাত্র যে ঠিকটা জানে সে ছাড়া সবাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে। এটা করে পরিচালকের সুবিধে হল যে রান্নাঘর, হলঘর, বেডরুম, ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় যে বিভিন্ন প্রকৃতির আলোচনা হয় সবকিছু এক জায়গায় নিয়ে এসে site ভাড়াটা কম করা।"
"উফ তোমার কি বুদ্ধি গো!" পচা তারিফ করে ওঠে।
"সেই দেখছি", জ্যেঠু অবশ্য গম্ভীর, "তা তুই তবে এবার বোঝা অভিনেতার অভিনয় ছেড়ে স্মৃতিশক্তি পরখ করাটা কেন দরকার পড়ছে।"
"পড়বে না?" আবার ভ্যাবলা শুরু করে, "কারণ ওই হলঘর!"
"আবার হলঘর," পচা ভেবেছিল হলঘর পর্ব শেষ।
পচার কথাটা পাত্তা না দিয়ে ভ্যাবলা বলতে থাকে, "yes, এই হলঘরে তো বেশিরভাগই দাঁড়িয়ে আলোচনা করছে। এখন সবাইকে যাতে দেখা যায়, পরিচালক এদের semicircle-এ থাকতে বলে। তো এরা তো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, কিন্তু একেবারে পিছনের দিকে যে আছে, সে কি দেখছে ভেবে দেখেছো কি?"
"কি দেখছে?" পচা ভেবে কুলকিনারা পায় না।
"বাকিদের মাথার পিছনটা", ভ্যাবলা একটু দম নেয়।
"তো?" পচা বুঝতে পারেনা এতে ভ্যাবলার অসুবিধেটা কোথায়।
"তো, পিছনের অভিনেতাকে তো খেয়াল রাখতে হবে কে কোথায় আছে। বাবা, জ্যাঠা, কাকা তো সবাই বিভিন্ন সিরিয়ালে বিভিন্ন চরিত্রে। আজকাল তো চুলও কারুর পাকেটাকে না, পাকলেও সামনের দিকের চুলে মেকআপ, পিছন দিক থেকে তো same রঙ। তো স্মৃতিশক্তি প্রবল না হলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলা dialogue দাদার পিছন লক্ষ্য করে বললেই তো হয়ে গেল, retake করে করে পয়সা খরচ।"
"তোমার কি বুদ্ধি গো!" পচা কথাটা repeat করে মাথা ব্যাপারটা ধরতে পেরে, "ঠিক বুঝেছো সমস্যাটা, পিছন থেকে তো বটেই, পুরুষ চরিত্র হলে তো মুখটা side থেকেও same লাগে। সবার এক style, দাড়ির মিহি আস্তরণ, বাড়েও না কমেও না, কে যে কেটে দেয়?"
"ওটাকে trim বলে পচাদা, trimmer বলে একটা যন্তর আছে, ওরকম করে বাড়িতেই কাটা যায়", ভ্যাবলা জানায়।
"Trimmer না হয় হলো, কিন্তু ভ্যাবোল, তুই খরচের ভয় retake করবি না, আরে একটু আধটু ভুল হলে তো editing আছে, নাকি সেটার দরকার নেই তোর সিরিয়ালে?" জিজ্ঞেস করেন জ্যেঠু।
"নেই মানে?" ভ্যাবলা লাফিয়ে উঠে বলে, "Powerpoint শিখলাম কি তবে এমনি এমনি?"
এই নতুন চমকের চোটে এবার জ্যেঠুর লাফানোর পালা, "কি বললি? Powerpoint দিয়ে editing? তুই কি পাগল হলি?"
"আরে চটছো কেন?" আশ্বস্ত করে বলে ভ্যাবলা, "আমি কি বলেছি Powerpoint দিয়ে editing করব? Editing করার তো লোক থাকবে। আমি concept-টা বোঝার জন্য ওটা শিখছি।"
"এখানেও concept!" জ্যেঠু এবার হতবাক, "তা Powerpoint তোকে কি concept দিলো?"
"ঝড়াং ঝড়াং করে slideshow-এর," গম্ভীর মুখে বলে ভ্যাবলা, "ধরো একটা সিনে হিরো বাড়িতে ডিনারের সময় ঢুকে বলে, "আজকে রাতে চিকেন পিজ্জা অর্ডার করেছি, কুড়ি মিনিটে আসছে!"
এদিকে হিরোর মা সেদিন মুড়িঘণ্ট রেঁধেছেন। তিনি তো শুনেই মুখ ফুলিয়ে বসলেন।
হিরোর ভাই আবার মুড়িঘণ্টের জায়গায় চিকেন পিজ্জার কথা শুনে পারলে নাচতে শুরু করত কিন্ত মায়ের ভয় পারে না।
হিরোর বোনের মনের অবস্থাটা হচ্ছে, "বাইরের খাবার বললি যখন তখন চিকেন পিজ্জা না বলে চিকেন বিরিয়ানি বলবি তো!"
বাড়ির সবথেকে ছোটো ছেলে মুড়িঘণ্ট থেকে মুক্তির আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে।
হিরোর নির্বিবাদী বাবা স্ত্রীয়ের ভয়েতে আর ছেলের প্রতি স্নেহে ভাবছেন পিজ্জাতে মুড়িঘণ্টের টপিং দিয়ে খেলে কেমন লাগতে পারে।
তো এতসব ইমোশন তো এক ফ্রেমে দেখানো যাবে না। তাই একেকজনের মুখের ক্লোজআপ উপর নীচ করে, চোখের উপর জুম করে, মুখের সমস্ত পেশির উপর বারবার ফোকাস করে, মুখের একপাশ থেকে অন্যপাশে আলতো করে প্যান করে দেখাতে হবে। সাথে পিছন থেকে আলোর দপ করে হঠাৎ জ্বলে ওঠা ও থেকে থেকে কড়াৎ কড়াৎ করে আওয়াজ। এগুলো দেখে মনে হয় না Powerpoint চলছে? বলো জ্যেঠু?"
"নিশ্চয়ই মনে হয় ভ্যাবোল," জ্যেঠু বলেন, "আরো অনেক কিছুই মনে হচ্ছিল তোর কথার ভাবে, এমনকি যখন তোর প্যান করার কথা শুনলাম, সেই শুনে তো আমার অন্য প্যানের কথা মনে পড়ছিল!"
পচা কিন্তু এসবের মধ্যেও পিজ্জা দোকানের টেকনিকাল দিকটা মনে করিয়ে দেয়, "কিন্তু ভেবলুদা, এতকিছু তো অনেক সময়ের ব্যাপার, তোমার পিজ্জা ডেলিভারি বয় তো চলে আসবে।"
"আসুক," এবার গর্জে ওঠে ভ্যাবলা, "এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়ুক, আমি এরকম শট আঠেরো মিনিটের একটা এপিসোডে ছাড়বো না। পুরো এক সপ্তাহ ধরে দেখাবো। সবার ইমোশন কি ফ্যালনা নাকি!"
"ঠিক," জ্যেঠুও ইমোশনাল হয়ে পড়েন মনে হয়, "তা সবই তো করে ফেললি, background score-টা বাদ রাখলি কি জন্যে? ওটা নিয়ে কিছু বল!"
"বলিনি? তাই নাকি?" ভ্যাবলা অবাক, "আরে ওটার জন্যই তো ভাষাটা বাঙলা হবে ঠিক করলাম।"
"মানে?" জ্যেঠু এবার যেন অবাক হতেও ভুলে যান।
"মানেটা সিম্পল," ভ্যাবলাও অবাক, "ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় সিরিয়াল করলে গানের জন্য তোমার চয়েস লিমিটেড। ইংরেজি সিরিয়ালে তো হিন্দি গান চলবে না, তেমনি হিন্দিতেও বাঙলা গান দিতে পারবে না। কিন্তু বাংলাতে তুমি পুরো তিনটেই পাচ্ছ।"
"বাঙলা সিরিয়ালে চলবে ইংলিশ গান?" জ্যেঠুর স্তম্ভিত মুখ দেখে ভ্যাবলা আশ্বস্ত করে।
"আরে ঘাবড়াচ্ছো কেন?" বোঝানোর চেষ্টা করে ভ্যাবলা, "ধরো সেই পিজ্জাটা এসে গেছে, সবাই টেবিলে বসে ভাত, মুড়িঘণ্ট, পিজ্জা, সব একসাথে খাচ্ছে, এমন সময়ে পরিবারের কর্তার ফোন এলো ফ্যাক্টরি থেকে। এবার ফোনে কথা বলতে বলতে ভাবো তুমি দেখছো অভিনেতা ঘামছেন আর একহাত বুকে বোলাচ্ছেন। ফোনের অপর প্রান্তে কি বলছে শোনা যাচ্ছে না। কোম্পানীর যদিও খুব টালমাটাল অবস্থা, সেটা দর্শক জানে। এমতাবস্থায় আমি Titanic সিনেমার গান চালিয়ে দিলাম।"
"Titanic?" জ্যেঠুও নিজের বুকে হাত বুলোতে শুরু করেন প্রায়।
"একদম! Titanic। বলো দেখি Titanic বলতে তোমাদের কি মনে হয়?"
"জাহাজডুবি!" জ্যেঠুর জবাব।
"নায়িকার হাত ছড়িয়ে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গি!" পচা একসাথে বলে ওঠে।
"correct!" ভ্যাবলার চোখমুখ যেন লটারি পাওয়ার আনন্দে উদ্ভাসিত, "এই দেখো, তাহলেই কেমন বোঝা গেল কোম্পানী ডুবছে আর সেই খবর পেয়ে কর্তার প্রাণপাখি বুকের খাঁচা থেকে বেরিয়ে উড়ে যেতে চাইছে।"
"তুই অস্কার পাবি", জ্যেঠুর গলা ইমোশনে বুজে আসে।
"সঙ্গে নোবেল ফ্রী!" পচাও গলা মেলায়।
"আর কিছু জানতে চাও কি?" গর্বিত স্বরে জানতে চায় ভ্যাবলা।
"জানার তো আর বিশেষ কিছু বাকি রাখিসনি রে ভ্যাবলা, সিরিয়ালের নামটা ঠিক করলি কি?" জানতে চান ঝানুজ্যেঠু।
জ্যেঠুর গলায় আদরের ডাক, ভ্যাবোলটা যে নেই খেয়াল করে ভ্যাবলা মাথার পিছনটা একটু চুলকে বলে, "এই রে! কোনো নাম তো এখনো ঠিক করিনি জ্যেঠু!"
"তাহলে আমি দিচ্ছি," বলেন ঝানুজ্যেঠু, "নাম না বলে concept বলতে পারিস। তোর বানানো ঘোলটার নাম দিস সিরিয়াল কিলার!"