Sunday, October 08, 2023

মনের মতো লেখা‌, মনের মতো খেলা, আমার ছোটোবেলা

ছোটোবেলা থেকে আমার শরৎকালের একটা আলাদা আকর্ষণ হচ্ছে পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলা। শরৎকালটা কার কি ভাবে আসে জানি না, আমার তো এই পত্রিকা হাতে পাওয়া থেকেই শুরু হয়। এমনকি, যেহেতু এই লোভনীয় পুজাবার্ষিকীটা অন্যগুলোর তুলনায় অনেকটাই আগে প্রকাশিত হয়, আমি এখনো কিন্তু মন থেকে চাই যে এটা যেন দেরিতে আমাদের বাড়িতে ঢোকে, কারণ একবার এই বইটা হাতে পেলে, বাইরের দুনিয়ার "এখনও পুজো তো দেরি আছে মশাই" ভাবটা অসহনীয় হয়ে ওঠে আমার কাছে।
এবার অবশ্য শুধু এটাই একমাত্র নয়, এবার শরতকালেই আরেকটি চমক রয়েছে অনেকের কাছে। এবার ছেলেদের ক্রিকেট বিশ্বকাপটা শুরু হচ্ছে শরতের মধ্যেই। আমার কিন্তু আবার ক্রিকেট দেখা শুরু তখন থেকে যখন ইন্ডিয়া টিম বলতে আমি শুধু কপিল দেব বুঝতাম। লাল ডিউস বলে দিনের আলোয় সাদা পোশাক পরিহিত খেলোয়াড়দের জমানার ১৯৮৭ সালের রিলায়েন্স ওয়ার্ল্ড কাপ আমার দেখা প্রথম বিশ্বকাপ। তখনকার কপিল দেবের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া টিম থেকে সৌরভ গাঙ্গুলীর টিম ইন্ডিয়া পর্যন্ত আমি খেলাটার মধ্যে থেকে অদ্ভুত এক আনন্দ পেতাম। কিন্তু তারপর কি যে ঘটল - গ্রেগ সাহেবের গোলমাল না চামড়া ঝলসানো চড়া গরম সামলে আইপিএল দেখার চরম চাপ - খেলাটা দেখার আনন্দটা যেন হারিয়ে গেলো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল বোধহয় বিশ্বকাপ।
এবার কি সেটাও হারিয়ে যাবে? কারণ বিশ্বকাপের মূল পর্বের শুরুটাই হচ্ছে অঘটন দিয়ে! ওয়েস্ট ইণ্ডিজ বাদ! কি কাণ্ড! এ যেন ব্রাজিলকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল। এই টিমটাই যে ক্রিকেটটাকে উপভোগ করতে শিখিয়েছিল! মনমাতানো ব্যাটিং তো ছিলই তাদের, আর ছিল বিপক্ষকে চুরমার করে দেওয়া তীব্র গতির বোলিং। কিরকম যেন প্রথম থেকেই পেস বোলিং আমার প্রিয় হয়ে উঠেছিল, গতির প্রতি ভয় হয়তো এমন উল্টো অ্যাট্রাকশনের কারণ। তাই ম্যালকম মার্শাল, কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশদের ভালোবাসতে বেশি সময় লাগেনি! শুধু কি বোলিং, তাদের চলাফেরার মধ্যেই যে পরিস্কার 'ডোন্ট কেয়ার' ভাবটা ফুটে উঠতো, সেটাই মনে হয় যথেষ্ট ছিল তাদের প্রতি সম্ভ্রম জাগাতে। অবশ্য এর জন্য বোধহয় এদের ক্যাপ্টেনই দায়ী! কারণ চিউংগাম চিবোতে চিবোতে রাজকীয় ঢঙে যখন ভিভ রিচার্ডস ব্যাট হাতে বিপক্ষের বোলারদের পরম অবজ্ঞায় ঠেঙাতো, তখন লোকটাকে কিং ভিভ বলাটাই ঠিক দেখাতো, আর রাজার বন্ধুবান্ধব যে বাকিদের পাত্তা দেবে না, সেটাই যেন স্বাভাবিক ছিল! তারপর ব্যাটিং করতে নেমে ছিল ডেসমণ্ড হেনস ও গর্ডন গ্রিনিজের ওপেনিং যুগলবন্দী। আমার ধারনা যে এদের দুজনের মুখের গড়নটাতে কিছু সমস্যা ছিল, তার কারণ দুজনেই কিরকম হাসতে হাসতে বিপক্ষের বোলিং লণ্ডভণ্ড করতো! হাসিটাকে ধরে রেখে ওরকম ব্যাটিং তাণ্ডব তো এই দুজন ছাড়া আর কাউকে তো করতে দেখিনি মনে হয়! ব্যাটিংটা সত্যিই যে এই দুজন উপভোগ করত, বোঝা যেতো। জুটির কথাই যদি বলি তো বলব আরো দুজনের কথা, হার্পার আর হুপার। কে কোনটা ছিল ভুলে গেছি, তবে একজন অলরাউণ্ডার ছিল, আরেকজন বোলার। এদের কেউ জুটি বলবে কি না জানা নেই, কিন্তু আমার নিজের কাছে এদের একটা অন্য মাহাত্ম্য ছিল। হয়তো ইণ্ডিয়া ম্যাচ চলাকলীন এদের ব্যাট হাতে নামতে দেখলাম। ব্যাস! আমি নিশ্চিন্ত! এবার চান্স আছে জেতার! কারণ এদের নামা মানে উপরের দিকের ব্যাট হাতে ঠ্যাঙানোর ধ্বজাধারীরা আউট! এরকম কিছু ঘটলে বেশ লাগতো ভারতের বিপক্ষে খেলা হলে! অবশ্য হার জিৎ যেটাই হোক না কেন, খেলাটাই যেন শুধু মনটাকে ভরিয়ে রাখত। আর ছিলো স্মৃতিগুলো, যা এখনও তাজা আছে বুঝতে পারছি! বোধহয় সেটাই স্বাভাবিক! কারণ যে লোকগুলো বল হাতে বিপক্ষের মাথা না তুলতে দিতে বদ্ধপরিকর আর ব্যাট করতে নেমে অপর পক্ষের আক্রমণ দফারফা করতে পিছপা নয়, তারাই আবার নিজেদের খেলাটা খেলে নিয়েই কিরকম যেন অন্য মানুষ। কখনও নিজেদের মধ্যে হাসিমজায় ব্যস্ত, আবার কখনও অন্য টিমের প্লেয়ারদের সাথে ইয়ার্কি করতে!
আমার তো আবছা হলেও মনে পড়ছে টিভিতে দেখা একটা দৃশ্যের কথা! খেলাটা ইন্ডিয়ার সাথে বলেই বোধহয় আগে থেকে দেখছিলাম। টসের মুহুর্ত, ক্যামেরায় দুই ক্যাপ্টেনকে দেখা যাচ্ছে! কয়েনটা মাটিতে পড়ে যেতেই আমাদের ক্যাপ্টেন সামনে নীচু হয়ে দেখতে যেতেই রিচার্ডস দিল এক হঠাৎ ধাক্কা! টাল সামলে তাকাতেই, কপিল না আজহার, খেয়াল নেই কে ছিল, দেখলো রিচার্ডসের বদমাইশি ভরা হাসিমুখ তার দিকে তাকিয়ে, ঠিক যেন পাড়ার বড় দাদা, ছোটদের সাথে কোনো ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলছে!
বাকিদের কথা জানিনা, ক্রিকেটে আমার কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানে এটাই। এগারোটা প্লেয়ার মাঠেতে একসাথে দুলকি চালে যখন নামতো, তখনই খেলাটা যেন কি একরকমের রাজকীয় মাত্রা পেত। ক্রিকেটিয় অ্যাগ্রেসন নিয়ে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কথা শুনেছি, কিন্তু অ্যাগ্রেসনের সৌন্দর্যটা ক্রিকেট মাঠে বোধহয় একটাই টিমের থেকে দেখেছিলাম - ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাই এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মূল পর্বে তাদের না থাকাটায় বেশ আশ্চর্য লেগেছিল। বুঝেছিলাম, টিমটা এখন সত্যি অনেকটাই পিছিয়ে গেছে প্রতিযোগিতায়। আশা রাখব, পরের চার বছরের মধ্যে আবার এই দলটা স্বমহিমায় ফিরে আসবে! আরেকটাও আশা রাখব, যদি অন্য আরেকটি দলকে পাই, যার খেলাটা দেখে ভালোবাসতে পারবো!
শুরুটা আনন্দমেলা দিয়ে করে খেলাতে ঢুকে পড়লাম। এবার আবার ফিরে আসি সাহিত্যে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যেরকম ওয়েস্ট ইন্ডিজকে না দেখে অস্বাভাবিক লেগেছিল, এবার পুজাবার্ষিকী আনন্দমেলা পেয়েও খানিকটা সেরকমই অনুভুতি হয়েছিল! আমি ঠিক কোন বছরে প্রথম পুজাবার্ষিকীটা নিয়েছিলাম মনে নেই এখন, কিন্তু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসবিহীন শারদীয়া আনন্দমেলাটা এই প্রথম! বোধহয় প্রথম যে উপন্যাসটা আমি পড়েছিলাম শীর্ষেন্দুবাবুর, এই শারদীয়াতে, তা হলো ঝিলের ধারে বাড়ি! প্রথমে কিন্তু আদৌ তেমন পছন্দের ছিলো না শীর্ষেন্দুবাবুর বড় লেখাগুলো। কত চরিত্র রে বাবা গল্পগুলোতে! তার উপর অদ্ভুতুড়ে প্লট, ভালো চোর - খারাপ চোর, বদমাইশ ভূত - ভীতু ভূত, ভীনগ্রহী, গুপ্তচর, বোকা গোয়েন্দা, দৌড়বীর, কৃপণ জমিদার, পাগলা সাহেব, ততোধিক ক্ষেপা শিক্ষক, গুপ্তধন, বিজ্ঞানী, গায়ক, বাদক, কি নেই! আর তাদের বয়স - শীর্ষেন্দুর গল্পে সাপোর্টিং কাস্টের গড় বয়স প্রায় একশোর কাছাকাছি হয় যদিও তাদের স্বাস্থ্য হবে মজবুত! সংক্ষেপে, মাথার মধ্যে গোলমাল পাকানোর জন্য যা যা বিদঘুটে কম্বিনেশন দরকার, সমস্ত তো একসঙ্গে থাকতোই উপন্যাসগুলোতে, সঙ্গে থাকতো আরো অনেক কিছু! তাই প্রথমদিকে মাথাটাথা গুলিয়ে একাক্কার! বাকিদের লেখার সাথে কিছুতেই মিলতো না, পড়তে পড়তে ভয় হতো, উপন্যাসের শুরুতে কোন চরিত্র কি ছিল ভুলে না যাই। কিন্তু কি আশ্চর্য, প্রতিবারই গল্পটার গভীরে কখন যে ঢুকে যেতাম, বুঝতেই পারতাম না। উপন্যাসের শেষের পাতায় এক নিরবিচ্ছিন্ন আনন্দ পেতাম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই! প্রথমে যতই চরিত্রের ঘনঘটা থাকুক না কেন, প্লটের মধ্যে ঠিক সবাই কিরকম মিশে যেত। কল্পনার সীমানা পার করে দেওয়া প্লটগুলো প্রতিবার পরিবেশিত হত মজার মোড়কে। এমনকি গল্পের নামগুলো পর্যন্ত মুখেতে হাসি নিয়ে আসতো। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস আসলে যেন রূপকথার হাতছানি - আধুনিক রূপকথা। তবে এই রূপকথা ঠিক ঠাকুমার ঝুলি হতো না, হতো ঝুলির বাইরে থাকা পৃথিবীটা নিয়ে রূপকথার এক মায়াময় জগত, যে কাহিনীগুলো খুব সহজেই কিশোর মনে দিতে পারতো খুশির দোলা। এই জগতের মানুষগুলোর চমকপ্রদ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও, তারা ভিতরে কিন্তু হয় সহজ সরল! তাই তো তাদের আকর্ষণ অমোঘ! এটাই তো কারণ যে প্রতিবার মুখিয়ে থাকি শীর্ষেন্দুর লেখাটা পড়ার জন্য, সে বয়স হোক না আমার কিশোরোর্ধ কি তারও অনেক বেশি! তাই তো এবার মনটা কিরকম করে উঠলো শীর্ষেন্দুর লেখাটা না দেখতে পেয়ে! হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম বয়সটা তাহলে সবারই বাড়ছে! কিন্তু তা বলে কি আর পাবো না আমার এই প্রিয় লেখকের উপন্যাস? নিশ্চয়ই নয়! আবার আশা করব পরের বার, না হলে তারও পরের বার! সাথে চাইব নতুন কাহিনীকারদের মধ্যে আরেকটি শীর্ষেন্দু যেন আবার আসে! আবার যেন দেখতে পাই আলো ঝলমলে কিছু লেখা, যে লেখায় পাবো প্লটের মজা, সীমাহীন কল্পনা, সত্যের জয়, লেখনীর জোর আর মনটাকে বড় করেও মনের বয়সটাকে বাড়তে না দেওয়ার ক্ষমতা!
প্রিয় শারদীয়ায় শীর্ষেন্দু ও বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে না পাওয়া কিরকম যেন সমাপতন লাগছে। তবে মিলটা শুধু মনখারাপের নয়, মনকেমন করা কিছু স্মৃতির ভাণ্ডার খুলে শরৎকালের চেনা আমেজটা এই যে দুজনে মিলে মনে পড়িয়ে দিল, সেটাই বা কম বলি কি করে!