Tuesday, October 12, 2021

ভূগোলেতে গোলমাল!

রাস্তাঘাটে চলতে গিয়ে মাঝেমধ্যে যে বিশেষ এক ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রায় প্রত্যেককে, সেটা হ'ল, "দাদা, এই জায়গাটা কোথায় একটু বলে দেবেন?" আমাকেও হয়েছে, হচ্ছে এবং অবশ্যই ভবিষ্যতেও হবে। মুশকিলটা হ'ল, অন্যদের তুলনায় ব্যবহারিক ভৌগলিক জ্ঞানটা আমার ঈর্ষণীয়ভাবে কম থাকার কারণে এরকম প্রশ্ন আমাকে কমবেশি প্রতিবারই বেশ বিপাকে ফেলে। কিন্তু কি গেরো, বাইরে বেরোলেই যে যেখানে আছে, সবাই যেন কিরকম ঠিকানা জানবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে আমার দিকে তাকিয়ে। "দাদা, অমুক বাড়িটা কোথায়? তমুক দোকানটা কোনদিকে? এখানে কি কোনো সুলভ আছে? ডাক্তার ঘটকের চেম্বারটা কি এদিকে? 'গাধা পিটিয়ে ঘোড়া' করার স্যার কি পাশের গলিতে টিউশন দিচ্ছেন এখন থেকে, ইত্যাদি, ইত্যাদি" প্রশ্নগুলো যে কি ভীষন ব্যতিব্যস্ত করে তোলে যে কি বলব! ওই যে প্রবাদ আছে শুনেছিলাম, মানুষের মুখ হচ্ছে খোলা বই, তা আমার ধারনা যে আমার মুখটা খোলা না হলেও বন্ধ অক্সফোর্ড অ্যাটল্যাসের প্রচ্ছদের মতো পাক্কা দেখতে লাগে। তাই না হলে লোকজন খামোখা আমাকেই বা কেন চলমান দিকনির্ণায়ক যন্ত্র ঠাওরাবে। নিজের পাড়ায়, বড় রাস্তায়, অন্যের পাড়ায়, যেখানেই যাই না কেন, ঠিকানা জানতে কেউ না কেউ ঠিক অপেক্ষায় থাকে। আমাকে পেলেই, "দাদা....." বলে এগিয়ে আসবে আর তারপর শুরু হবে "আবার খাবো দোকানটা কোথায় বলতে পারেন?" জাতীয় প্রশ্ন। আমার কাছে যা দাদাগিরির গুগলি পর্বের মতো! আমি তো স্বপ্ন দেখি যে আমি মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছি আর মহাকাশে মাঝপথে আমার বিমানের জানলায় কোনো অন্য গ্রহের ভ্রাম্যমান জীব টোকা দিয়ে আমাকে ক্র্যাব নেবুলা যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিতে বলছে।

সমস্যাটা হচ্ছে, আমার মুখই হোক কি চোখ, কান, কপাল, ভুরু (মাস্ক পরলেও যেহেতু লোকে আমাকেই ধরে ঠিকানা বুঝিয়ে দিতে বলে) হোক, যেটাই দেখে লোকে ভাবে যে আমার মধ্যে নিশ্চয় কোনো ভাস্কো-ডা-গামা লুকিয়ে আছে, তাদের জন্য আরেকটা প্রবাদই যথেষ্ট, 'ডোন্ট জাজ্ আ বুক বাই ইটস কভার', তাই আমার মুখ দেখে আমাকে চলমান অ্যাটলাস ভাবলেও, পাতা ওলটালেই ভূগোলেতে গোল ধরা পড়বে! কিন্তু পাতা উল্টে পরখ করা তো দূরস্থান, বইমেলা গেলেও দেখেছি লোকে কোনো অজ্ঞাত কারণে ধরে নেয় আমি এযুগের কলম্বাস আর আমাকে কোন স্টল কোথায় জানতে চায়।

তবে ব্যাপারটা কিন্ত বরাবর এরকম ছিল না। প্রাইমারিতে একবার ভূগোলে ৫০এ ৪৮ পেয়েছিলাম। ব্যাস, তারপর কি যে হল কে জানে! মাধ্যমিকে ওই ৪৮টা টেনেটুনে ৬৮ অবধি গেছিল, কিন্তু নিচের ৫০ ততদিনে তো ১০০ হয়ে গেছে। ঠিক যেন ম্যাগনেটিক হিল, মনে হবে উঠছি, কিন্তু আসলে পড়ছি। তাই যদিও আমার ভূগোলের জ্ঞানটা প্রাইমারিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা পেরিয়ে মাউণ্ট এভারেস্টের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু রাস্তায় বোধহয় গঙ্গোত্রী হিমবাহে পিছলে গিয়ে সটান কাশ্মীরের মতো উপত্যকা অঞ্চলে ফাইনালী ল্যান্ড করল! দেখলেন তো কিরকম কাঞ্চনজঙ্ঘা, এভারেস্ট, গঙ্গোত্রী, কাশ্মীরকে এক জায়গায় নিয়ে এলাম! তবেই বুঝুন ভূগোলের জ্ঞানটা ঠিক কতটা হলে এরকম তুলনা করতে পারি।

একবার আমাকে সেলিমপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে কেউ ২৪০ রুটের বাস কোথা থেকে ছাড়ে জিজ্ঞেস করেছিল। পাশে আমার এক স্কুলের বন্ধু ছিল, আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম উত্তরটা, ব্যাস পরদিন আমার বন্ধুমহলে ঘটনাটা রটে যায় যে আমি ২৪০ বাসস্ট্যান্ড চিনি না। ঘটনাটা যে সময়ের, তখন বাসটার টার্মিনাস ছিল সেলিমপুর থেকে দুস্টপেজ দক্ষিন পশ্চিমে আর দক্ষিন কলকাতায় থাকলে সেটা না জানাটা আর পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কি সেটা না জানা প্রায় সমার্থক!

কিন্তু কি করব, ছোটো থেকে বাবা মা একটা অদৃশ্য লক্ষণরেখা টেনে দিয়েছিল আমার জন্য যেটার ব্যাস কয়েকশো মিটার। তার বাইরে বেরোলে কি হবে বলেনি তবে বেরোতে গেলেই মায়ের চোখ আর বাবার মুখ আর তাদের আদেশ অমান্য করলে সেই চোখমুখের ভৌগোলিক পরিবর্তন কি হতে পারে কল্পনা করলেই আমি আবার ব্যাক টু অরবিট হয়ে যেতাম। তাই স্কুলবেলায় বন্ধুবান্ধব যতই এদিক ওদিক ঘুরে নিজেদের প্র্যাক্টিকাল নলেজ বাড়াক, আমি তখনও থিওরি নিয়েই পড়ে আছি আর উল্টোডাঙার কোন জায়গাটা উল্টে থাকতে পারে জাতীয় বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি। না হলে কি বন্ধুরা যখন লায়ন্স সাফারি পার্কে ভোরবেলা বেড়াতে যাবে বলে তখন অত্যন্ত গম্ভীরমুখে মন্তব্য করি, "ওখানে কি এখন লায়ন থাকে?" এই কেলেংকারিটা ছিল আমার ২৪০ বাসস্ট্যান্ডের অবস্থান নির্ণয় করো সমস্যাটার থেকেও সরেস কিন্তু এটা যে কি করে ধামাচাপা দিতে পেরেছিলাম সে কেবল আমিই জানি।

তো যাই হোক, স্কুল পাশ করে কলেজে ঢুকে পাখাটা যেই গজাতে শুরু করল, আমি ভাবলাম যে ব্যস এবার না হয় বন্ধুদের সাথে কলকাতা চষে বেড়াব আর সেই ময়কায় আমিও রাস্তাঘাট চিনে নেব। কিন্তু চিনব কি করে? বন্ধুবান্ধব তো ততদিনে সিনেমা হল, খাবার দোকান, বইয়ের দোকান - কোথায় কি আছে জেনে বসে আছে। যেখানেই যাই না কেন আমার অবস্থা হতো আকাশের পাখির ঝাঁকের শেষের দিকের পাখিদের মতো। সামনের পাখিকে ফলো করলেই হলো, ভাবনাচিন্তার দরকার নেই। তাই কলেজে থাকাকালীন উড়লাম ঠিকই, তবে রাস্তাঘাট চেনাটা অল্পই হলো।

আমার স্কুল ছিল আমাদের বাড়ি থেকে চারটে মতো স্টপেজ উত্তরে আর কলেজ চারটে স্টপেজ দক্ষিনে, তাই সেখানেও নতুন রাস্তা বের করার বিশেষ উপায় ছিল না বললেই হয়। ছোটবেলায় নতুন কোথাও গেলে বাবা রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেত, কিশোর বয়সে বন্ধুরা। তাই ভৌগলিকভাবে স্বাবলম্বী হবার একমাত্র উপায় ছিল বিয়ের পর। কিন্তু তাও হল না। ঘটনা হচ্ছে, আমাদের বিয়েটা হয়েছিল আন্তঃজেলা বিবাহ। মানে আমি এক জেলার, আমার স্ত্রী অন্য জেলার। এবার হল কি, আমার গিন্নি যেহেতু পড়াশোনাটা খানিকটা কলকাতায় করেছে এবং তখন নিজের বাড়ি থেকে কলকাতায় বছরভর যাতায়াত করতো, তাই নিজের জেলা সমেত আমার শহরটাকেও আমার থেকে কম বয়সেই চষে ফেলেছিল। তাই জীবনে মাত্র একবার আমার ওকে আমার দিকের আত্মীয়স্বজনদের বাড়িগুলো চেনানোর সুযোগ হয়েছিল আর ও আমাকে ওর জেলাটা তো বটেই মায় আমার শহরটাও আরেকবার করে চিনিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে আমার চেনাজানা কেউ বাড়ী শিফ্ট করলে আমার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে, আমার স্ত্রীকে ঠিকানাটা জানানো এবং তারপর ওকে ধ্রুবতারা মনে করে সমুদ্রে দিকভ্রান্ত নাবিকের মতো ফলো করা। এই করে আমার ভূগোলে গোল তো রয়ে গেলই, উপরন্তু চান্সই পেল না গোল কমার।

কিন্তু সেটা কে বোঝাবে পথিকবরদের। তাদের প্রশ্নের তো কোনো বিরাম নেই। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের গলিটা যেটাকে গলি না বলে গলির গোলমাল বলা উচিত। একটা গলি যে এতগুলো শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে পারে সেটা এখানে না এলে বিশ্বাস করা কঠিন। এ যেন গলিদের সমাজে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্য তৈরি হয়েছিল। শুরুটা বড়রাস্তা থেকে স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে, কিন্তু তারপর কয়েক মিটার অন্তরই ডান আর বামদিকে জন্ম দিয়েছে আরো কিছু গলির যেগুলো আবার অনুপ্রাণিত হয়ে প্রসব করেছে তস্য গলিদের - মানে ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে তাতে এর শাখার ব্যাপ্তি দেখলে যেকোনো মাঝারি সাইজের নদী লজ্জা পেয়ে যাবে। আর নদীও যেমন সমুদ্রে গিয়ে মেশে, এই গলিটাও গিয়ে মিশেছে রেললাইনে। তাই লোকজন এখানে ঢুকে যেমন বাড়ি, দোকান এসবের খোঁজ করে তেমনি ক্যানিং লোকালের টাইম এবং কোন প্ল্যাটফর্মে পড়বে জিজ্ঞেস করলেও সেটাকে আউট অফ সিলেবাস বলা যাবে না কোনোমতেই। উপরন্তু যোগ হয়েছে কলকাতা শহরের বাড়ির ঠিকানা বসানোর অদ্ভুত নিয়ম। কেন কে জানে, কিন্তু এই শহরটাতে প্রবেশ ইস্তক ল্যাটিটিউড ও লঙ্গিটিউড নিজেদের মধ্যে এমন জট পাকিয়ে ফেলেছে যে ১৯ নং বাড়ির পরেরটা ২০ হবে না ৪২০ হবে সেটা নিয়ে বাজী ধরলে ৪২০র জেতার সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের পাড়াতেও এর অন্যথা নেই আর তাই লোকজন ঠিকানা না জিজ্ঞেস করে বাড়ির দ্রষ্টব্য ব্যক্তি বা ঘটনার উল্লেখ করে। তাই অমুকের বাড়ি বা তমুকের দোকান যেমন জানতে চাওয়া হয় তেমনি বাঁদরে কামড়ানো বা গরুতে গুঁতোনো ছেলেটার বাড়ি জানতে চাইলে দিক নির্দেশ করাটা সুবিধের হয়। তবে এসব ব্যাপার জানাটাও তো চাট্টিখানি কথা নয়, তাই এখন যদি অচেনা কেউ আমার কাছে অজানা ঠিকানা জানতে চায়, স্রেফ বলে দিই আমি এ পাড়ায় থাকি না, কাকুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি।

লেখাটা শুরু করতে গিয়ে মনে আশঙ্কা ছিল শেষটা কি করে করব। কিন্তু সেখানেও পরিত্রাতা হয়ে দেখা দিল এক অজানা পথিক আর ওনার এক অসামান্য জিজ্ঞাসা। ব্যাপারটা হল কি এক সকালে আমি ঢাকুরিয়া ফ্লাইওভারের সামনে আমার এক কলিগের গাড়িতে লিফ্ট নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার সামনে ফ্লাইওভার দিয়ে এসে একটা বাস থামল। সেটার থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। আর নেমেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "দাদা, এখানে মধুসূদন মার্কেটটা কোথায় বলতে পারেন?" প্রশ্নটা বুঝতে যা কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল। এ যেন মুখস্থ করা প্রশ্নের কানের পাশ দিয়ে আসা আরেকটা প্রশ্ন। আমার সামনে তখন দুটো উত্তরের হাতছানি। প্রথমটা হল, দাদা এখানে এরকম কোনো মার্কেট নেই। কিন্তু দ্বিতীয়টা যে আরো লোভনীয়। রাস্তার উল্টোদিকে দেখতে পাচ্ছি দক্ষিণাপণ মার্কেট আর মধুসূদন মঞ্চ একটা গলির তফাতে পাশাপাশি বিরাজ করছে। তাই যেন পরীক্ষার লাস্ট বেল পড়ার পর কাম্পুচিয়ার রাজধানী নামের সাদৃশ্য অনুযায়ী কাম্বোডিয়া হলেও হতেও পারে মনোভাব নিয়ে দক্ষিণাপণ আর মধুসূদন মঞ্চের মাঝের গলিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, "দাদা, ওদিকে আপনি দুটোই আংশিক পাবেন, এবার আপনি বেছে নিন আপনার মতো করে।" ভদ্রলোকের হতভম্ব মুখের আবহাওয়ার পূর্বাভাসটা বেশ উপভোগ করছিলাম। তবে কলিগের গাড়ি এসে যাওয়াতে কোনোপ্রকার দুর্যোগ ঘনাবার আগেই আমি পগার পার!

6 comments:

swapan said...

খুবই মনোরম রম্য রচনা। শুধুমাত্র ভাল বললে কম বলা হবে। অভ্যেসটা চালিয়ে যেতে হবে। আসলে গল্পের উপকরণ এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলোকে ভাবনা-চিন্তা দিয়ে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে নিলেই গল্প তৈরি হয়ে গেল। গল্পের মাধুর্যের খাতিরে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যেতেই পারে, অবশ্যই প্রসঙ্গের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এটা ঠিক যে শুরু আর শেষ করাটা বেশ শক্ত।

Unknown said...

অসম্ভব ভালো হয়েছে একটা সুন্দর কৌতুকের মধ্যে দিয়ে যেটা বলেছিস অসাধারণ

anirban said...

একে সত্যাশ্রয়ী বলতে পারো কিন্তু!

anirban said...

মা, তুমি তোমার নামটা লিখো এবার থেকে!

anirban said...
This comment has been removed by the author.
Rajarshi Sengupta said...

Khub shundor hoyeche re. Madhusudan market ta khuje dekhte hobe ebar Kolkata gele